
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র (৪ অগস্ট, ১৯০৫ – ৩ নভেম্বর, ১৯৯১) ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভাধর বাঙালি বেতার সম্প্রচারক, নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক। কলকাতার এই মহারথী বাংলা সংস্কৃতি ও আকাশবাণীর ইতিহাসে এমন এক স্থান অধিকার করেছেন, যা আজও স্মরণীয়।
প্রথম জীবন ও শিক্ষা
উত্তর কলকাতায় মাতুলালয়ে জন্ম নেওয়া বীরেন্দ্রকৃষ্ণের আদি নিবাস ছিল অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলার উথালী গ্রামে (বর্তমানে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা)। তাঁর পিতা রায়বাহাদুর কালীকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন একাধিক ভাষাজ্ঞ, সাহিত্যরসিক ও নিম্ন আদালতের দোভাষী। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের শৈশব কেটেছিল এক সংস্কৃতিমুখর পরিবেশে। তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং অল্প বয়স থেকেই সাহিত্য ও নাট্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
কর্মজীবন
১৯৩০-এর দশকে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যোগ দেন আকাশবাণী কলকাতায়। সেখানেই শুরু হয় তাঁর দীপ্ত অধ্যায়। দুর্গাপূজার সূচনালগ্নে সম্প্রচারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানে তাঁর ভাষ্য ও শ্লোকপাঠ বাঙালি সমাজে এক অনন্ত ছাপ রেখে যায়। এই সঙ্গীতালেখ্যটি রচনা করেছিলেন বাণীকুমার এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক—কিন্তু সেই অনুষ্ঠানকে অমর করে তোলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠই।
তিনি একাধিক নাটক রচনা, প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। রেডিওর জন্য বহু ধ্রুপদি কাহিনি নাট্যরূপ দেন এবং সাতটি ছদ্মনামে অসংখ্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ‘মেস নং ৪৯’, ‘সাত তুলসী’, ‘ব্ল্যাকআউট’ ইত্যাদি তাঁর রচিত নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্র জগতেও কাজ করেছেন—১৯৫৫ সালে ‘নিষিদ্ধ ফল’ সিনেমার চিত্রনাট্য তাঁরই লেখা।
উত্তরাধিকার
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন একজন বিশিষ্ট বাঙালি বেতার সম্প্রচারক ও নাট্যশিল্পী। তাঁর মহিষাসুরমর্দিনী অনুষ্ঠান আজও মহালয়ার দিনে আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত হয়। ১৯৭৬ সালে এই অনুষ্ঠান পরিবর্তন করলে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
২০১৯ সালে তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে “মহালয়া” নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। ২০০৬ সালে তাঁর কন্যা সুজাতা ভদ্র সারেগামা ইন্ডিয়া থেকে তাঁর কাজের স্বীকৃতি পান। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠ ও কর্ম বাঙালি সংস্কৃতিতে আজও অনুপ্রেরণার উৎস।
সাহিত্য ও রচনা
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র শুধু কণ্ঠশিল্পীই নন, ছিলেন এক প্রজ্ঞাবান সাহিত্যিকও। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে —
- হিতোপদেশ (১৯৪৮)
- বিশ্বরূপ-দর্শন (১৯৬৩)
- রানা-বেরানা (১৯৬৫)
- ব্রতকথা সমগ্র (১৯৮৫)
- শ্রীমদ্ভাগবত: দ্বাদশ স্কন্দ (উপেন্দ্রচন্দ্র শাস্ত্রীর সঙ্গে, ১৯৯০)
