
ড. বিধানচন্দ্র রায় (১৮৮২-১৯৬২) ছিলেন একাধারে একজন প্রখ্যাত চিকিৎসক, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ এবং পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর জীবন ছিল জনসেবা ও দেশ গড়ার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
প্রাথমিক জীবন ও শিক্ষা
১৮৮২ সালের ১ জুলাই বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন বিধানচন্দ্র রায়। তাঁর পিতা প্রকাশচন্দ্র রায় ছিলেন একজন ব্রাত্ম সমাজের সদস্য এবং মা অঘোরকামিনী দেবী ছিলেন এক জমিদারকন্যা। পরিবারের আর্থিক সংকট সত্ত্বেও তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। প্রথমে পাটনা কলেজ থেকে গণিতে বি.এ. অনার্স শেষ করে ১৯০৬ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এল.এম.এস এবং ১৯০৮ সালে এম.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ইংল্যান্ডে গিয়ে মাত্র দু’বছরের মধ্যে এমআরসিপি (লন্ডন) এবং এফআরসিএস (ইংল্যান্ড) অর্জন করেন, যা ছিল তাঁর অসাধারণ প্রতিভার প্রমাণ।
চিকিৎসা পেশায় অবদান
১৯১১ সালে প্রাদেশিক স্বাস্থ্য সেবায় যোগ দিয়েও পরে সরকারি চাকরি ছেড়ে তিনি শিক্ষকতায় মন দেন। ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুল (বর্তমান এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ) এবং কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজে (বর্তমান আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ) অধ্যাপনা করেন। তিনি শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, দেশের অন্যতম সেরা চিকিৎসক হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ বহু বরেণ্য ব্যক্তির ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন তিনি। যক্ষ্মা হাসপাতাল স্থাপন, চিত্তরঞ্জন সেবাসদনকে শক্তিশালী করা এবং গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার প্রসারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
রাজনৈতিক যাত্রা ও মুখ্যমন্ত্রীত্ব
চিত্তরঞ্জন দাশের অনুপ্রেরণায় ১৯২৩ সালে রাজনীতিতে আসেন বিধানচন্দ্র। তিনি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করে বাংলা বিধান পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণও করেন। ১৯৩১ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের পঞ্চম মেয়র নির্বাচিত হন।
১৯৪৮ সালের ২৩ জানুয়ারি, ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু, অর্থাৎ ১৯৬২ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ পুনর্গঠন ও উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যায়।
মূল অর্জন ও উত্তরাধিকার
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ড. রায়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো পরিকল্পিত শহরগুলির প্রতিষ্ঠা। সল্টলেক (বিধাননগর), কল্যাণী, দুর্গাপুর এবং অশোকনগরের মতো শহরগুলি তাঁর দূরদৃষ্টির ফল। শিক্ষাক্ষেত্রেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম; রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ তাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৬১ সালে ভারত সরকার তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করে। তাঁর জন্মদিন, ১ জুলাই, ভারতে জাতীয় চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালিত হয়। ড. বিধানচন্দ্র রায়ের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং তাঁর জনসেবামূলক কাজ আজও তাঁকে অমর করে রেখেছে। তাঁর বাড়িটি তাঁর মায়ের নামে ‘অঘোরকামিনী দেবী’ নার্সিং হোমে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং তাঁর স্মৃতিতে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সম্মাননা চালু আছে।
ড. বিধানচন্দ্র রায় ছিলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব, যিনি তাঁর জ্ঞান, মেধা ও কর্ম দিয়ে একটি রাজ্য তথা দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন।